প্রবন্ধ


স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী
Mehnaj Belal
Roll : 19/03 Reg: 03062 Session : 2018-19 Faculty of Food Science and Technology Chattogram Veterinary and Animal Sciences University
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল একটি ভূখন্ডের, যার নাম বাংলাদেশ। সবুজের জমিনে রক্তিম সূর্যখচিত মানচিত্রের এ দেশটির ৪৯ বছর পূর্তি উদযাপন করেছি আমরা। ৫০ বছরে পা রাখতে চলেছে প্রিয় বাংলাদেশ। ২০২১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করবে বাঙালি জাতি। বিজয় অর্জনের পর ৪৯ বছরের পথচলায় দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। একাত্তরে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা একটি স্বতন্ত্র দেশ পেয়েছি, আর তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গড়ে তুলতে চলেছি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

স্বাধীনতা অর্জনের কারণেই বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা গত কয়েক দশকের চেয়ে যে শীর্ষে অবস্থান করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না| শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার যেভাবে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিয়েছে তা রীতিমতো পৃথিবীর কাছে বিস্ময়কর। স্বাধীনতার পর তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ আখ্যা দিয়ে যারা অপমান-অপদস্থ করেছিল, সেই তাদের কণ্ঠেই এখন বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা। দারিদ্র্ আর দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পথে অনেকের জন্য রোল মডেল।

তবে ২০২০ সালের গ্লানি আর দুর্যোগ কাঁধে নিয়েই আমরা ২০২১ সালে প্রবেশ করেছি। সব দুর্যোগ ও গ্লানি ধুয়ে মুছে ফেলতে পারিনি বলেই করোনা, চরম ধর্মীয় উগ্রবাদ ও রোহিঙ্গা সংকট নিয়েই নতুন বছরে পদার্পণ করতে হচ্ছে। তাই এগুলোকে মেনে নিয়ে নয়, প্রবল প্রতিরোধী মন নিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে নতুন আশায় বুক বাঁধতে চাই। গ্লানি মুছে, দুর্যোগ কাটিয়ে বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।

মিথ্যার ধর্মীয় উন্মাদনায় সাধারণ মানুষকে বুঁদ করে রেখে মুষ্টিমেয় শাসক আর মিলিটারি পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ এবং সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। আমরা সেই রকম রাষ্ট্র চাইনি, চাইনি বলেই সংগ্রাম, যুদ্ধ এবং এত বড় ত্যাগ। সুতরাং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন এবং সর্বপ্রকার বৈষম্য থেকে মুক্তির মৌলিক সোপান ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই প্রকৃতপক্ষে আসল বাংলাদেশ।

এবারে স্বাধীনতা অর্জনে ৪৯তম বছরের শেষ প্রান্তে এসে বিনম্র চিত্তে বীর শহীদদের স্মরণ করছে জাতি। কিন্তু এবারের স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের মাহাত্ম্য, মর্মার্থ, ব্যাপ্তি, গুরুত্ব নতুন করে অনুধাবণ, অনুস্মরণের আলাদা বৈশিষ্ট্য নিহিত আছে কারণ বাঙ্গালির গৌরব উজ্জ্বল স্বাধীনতা, দেশ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নতুন করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে পাকিস্তানি পরাজিত শত্র‌ু এবং এদেশীয় বিশ্বাসঘাতক, উগ্র গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গার মধ্যদিয়ে বিজয় অর্জনের এই মাসে আস্ফালন দেখাল।

ব্যক্তিগতভাবে আমরা অনেকেই অটল থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সামষ্টিক জায়গাটির সংকোচন ঠেকাতে পারিনি। কারণ তা ঠেকানোর জন্য সাংগঠনিক কার্যক্রমের যে আবশ্যকীয়তা ও অপরিহার্যতা ছিল, সেটি রাষ্ট্র, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কোনো জায়গার সংগঠন থেকেই করা হয়নি। একদিকে ঠেকানোর কার্যক্রম নেই, অন্য দিক থেকে সর্বগ্রাসী আগ্রাসন। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ৪৫ বছরের প্রস্তুতিতে তারা এতই শক্তি অর্জন করেছে যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবাহী রাজনৈতিক পক্ষ ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার হুমকি দিতে পারে।

হ্যারল্ড লাস্কি তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘আ গ্রামার অব পলিটিকস' গ্রন্থে বলেছেন, "স্বাধীনতা অবশ্যই থাকবে, তবে কোনো কিছুই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকতে পারবে না, থাকলে সে রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। "১৯৮৯ সালে পশ্চিমা বিশ্বের কঠিন নিষেধাজ্ঞা ও সমালোচনা উপেক্ষা করে তিয়েনআনমেন স্কয়ারের বিদ্রোহ দমন করতে পেরেছিল বলেই চীন আজ বিশ্বশক্তি। সব কিছুর উর্ধ্বে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা। সব গণতান্ত্রিক দেশের মতো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অটল নিষ্ঠাবান একজন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার নেতৃত্বে সার্বক্ষণিক জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল থাকলে ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং রোহিঙ্গা সংকট এত দূর গড়াতে পারত না। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর শক্তি আর উদ্দীপনায় আমরা সব সংকট কাটিয়ে উঠব এই প্রত্যাশা করি। স্বাধীনতা ও বিজযের গৌরবে অভিষিক্ত হোক দেশের প্রতিটি মানুষ।

বিঃ দ্রঃ উক্ত লেখার সম্পূর্ণ দায়ভার লেখকের

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি খোলা চিঠি
এ.এন.এম জাহিদ হাসান
টেকনিকেল অফিসার, এপ্লাইড ক্যামিস্ট্রি এবং ক্যামিকেল টেকনোলজি বিভাগ
প্রিয় বঙ্গবন্ধু,

সালাম নিবেন। আশা করছি আল্লাহর অশেষ রহমতে আপনি শহীদি মর্যাদায় অত্যন্ত সুন্দর এবং ভালোভাবে আছেন। আপনি জেনে খুশি হবেন যে, আপনার রেখে যাওয়া এ দেশ স্বপ্নের বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি স্তরে উন্নয়নের ছোঁয়া, দেশ এখন উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে। বিশ্বের বুকে “বাংলাদেশ” একটি উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। আপনার সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন, আমাদের প্রানপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রি শেখ হাসিনা আপনার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। আপনি যে হতদরিদ্র বাংলাদেশকে নিয়ে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছেন- বিশ্বের বুকে আজ লালিত স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। এ দেশের প্রতিটি সেক্টরে বিশেষ করে দক্ষিণ বঙ্গের উন্নয়নের চেহারা পাল্টেছে , মেট্রোরেল স্থাপিত হচ্ছে, স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মিত হচ্ছে, কর্ণফুলি নদীতে টানেল হচ্ছে, মহাকাশে আমাদের স্যাটেলাইট, শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে। যখন আপনার রেখে যাওয়া এদেশের প্রতিটি ক্ষেত্র এগিয়ে যাচ্ছে, শুধুমাত্র দুঃখজনক ও নির্মমতা হচ্ছে- আপনাকে এই সময় কাছে না পাওয়াটা। বঙ্গবন্ধু আপনি জেনে খুশি হবেন যে আপনাকে এবং আপনার পরিবারের সদস্যদের যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল- তাদের বিচার বাংলার মাটিতে হয়েছে। আপনি আরও খুশি হবেন যে, স্বাধীনতার সময়ে যারা আপনার বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, যারা আপনার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বাধা প্রদান করেছিল সেই রাজাকার, আল বদর, আল শামশ আজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। সেই রাজাকারদের উত্তরসূরীরা ষড়যন্ত্র করলেও আপনার সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বের কারণে সুযোগ তৈরী করতে পারছে না। আপনি ভালো থাকবেন। আপনার রেখে যাওয়া এদেশের মাটি ও মানুষ আপনাকে ভোলেনি। আপনার সবুজ- বেগুনী ধান ক্ষেতের সুবিশাল প্রতিকৃতি গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড-এ স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের বন্ধু প্রতিম রাষ্ট্র ভারত আপনাকে মরণোত্তর গান্ধী শান্তি পুরুষ্কারে ভূষিত করেছে। আমরা আপনাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। আপনার রেখে যাওয়া বাংলাদেশ আপনাকে ভোলেনি। আজ প্রতিটি পাড়া-মহল্লায়, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে। আপনি ক্ষমা করবেন এই জাতিকে যাদের কিছু অদ্ভূত, পথভ্রষ্ট বিবেকহীন মানুষ নামের পশুর কারণে আমরা আপনাকে অকালে হারিয়েছি। আপনি না থাকলে আমরা বাংলাদেশ নামক স্বাধীন এই দেশটি পেতাম না। তাই শ্রদ্ধাভরে আপনাকে স্মরণ করছি। ভালো থাকবেন ওপারে।

ইতি-
আপনার স্বাধীন দেশের নাগরিক।

বিঃ দ্রঃ উক্ত লেখার সম্পূর্ণ দায়ভার লেখকের

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ
চমক চন্দ
সহকারী রেজিস্ট্রার, পিআরটিসি, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়।
আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে আমাদের ছোট্ট এই লাল-সবুজ পতাকার দেশটি। যে দেশটির প্রবৃদ্ধি এখন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও বেশী এবং যে দেশটি এখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য একটি রোল মডেল। সেই স্বাধীন বাংলাদেশ নামটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে যে অমর, চিরবিপ্লবী মহানায়কের নাম চলে আসে তিনি আমাদের সকলের প্রিয়, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু দেশ ও দশের কথা ভেবেছেন। তিনি মনে ও প্রাণে গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সবসময় মনে করতেন ব্যক্তির চেয়ে দল বড় আর দলের থেকে দেশ। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের মানচিত্র বিশ্বের বুকে ঠাঁই পেতনা। বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কোন বাঙালীর নেই। তিনি যেমন ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী মুক্তির সংগ্রামের নায়ক ঠিক তেমনি স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের স্বপ্নদ্রষ্টা। সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন একটি পরিবারের পিতার মত তাইতো তিনি জাতির পিতা।

বঙ্গবন্ধু শোষণহীন সমাজ গঠনের জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। বাংলার স্বাধীনতা পরবর্তী শিল্প ও কৃষিখাতে সমান মনোযোগী ছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ এই চার বছরে জাতির পিতা যে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়েছিলেন তা আগস্টের এক কালোরাতে কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই নি:শেষ হয়ে যায় স্বাধীনতাবিরোধী বিপথগামী কিছু সেনার হাতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু’ ও তার পরিবারের উপর বর্বরোচিত হামলা এবং নৃশংস হত্যাকান্ড বাংলার ইতিহাসের কালো অধ্যায় হয়েই থাকবে। যে মানুষটি দেশ ও দেশের মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরণ সংগ্রাম করে গেছেন সেই মানুষটি ও তার পরিবারের উপর ঘৃন্য বর্বরোচিত এই হামলা ছিল বাংলার স্বাধীনতাপ্রিয় প্রতিটি মানুষের পিঠে চাবুকের কষাঘাতের মতো। বাঙালী কেবলমাত্র একজন পিতাকেই হারায়নি, হারিয়েছিলো একটি ছায়াশীতল বটবৃক্ষ, যার অভাব আজও জাতি অনুধাবন করে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সেদিন বঙ্গবন্ধু’ই কেবল রক্তাক্ত হননি, রক্তাক্ত হয়েছিলো স্বাধীন বাংলার লাল সবুজ পতাকাটিও। সেই রক্তের দাগ আজও শুকায়নি।

ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নেই অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তিনি গ্রেফতার হন, তারপর ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গন অভ্যুত্থান, ১৯৭০এর নির্বাচন কোথায় নেই বঙ্গবন্ধুর নাম । বাংলার ইতিহাসের পাতায় পাতায় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামটি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা আজও কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে রয়েছেন। তিনি বেঁচে থাকবেন ততদিন, যতদিন বইবে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বীরত্বগাঁথা বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, লেখা থাকবে বিশ্ব ইতিহাসের দরবারেও। জাতির পিতার আত্মত্যাগ কোন কিছুর বিনিময়ে শোধ করা যাবে না।

বঙ্গবন্ধুর “অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে”এই আত্মত্যাগের কথা বারবার উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু বললেন “বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে, আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালীকে দাবায় রাখতে পারবা না”। (পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে প্রহসণমূলক মিথ্যা মৃত্যুদন্ড রায় বাস্তবায়নের জন্য যখন ইয়াহিয়া খান সকল বিচারককে ডেকে পাঠান ) বঙ্গবন্ধু তখনই বুঝে গিয়েছিলেন যে তাকে হত্যা করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান সরকার একাট্টা হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। বঙ্গবন্ধু বন্দী অবস্থায় তার কারাকক্ষের পাশে নিজেই নিজের কবর দেখতে পান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন ভয় নেই আমি তৈরি আছি। বঙ্গবন্ধু পাক হানাদারদের শুধু একটা অনুরোধ করেছিলেন তার মৃত্যুর পর তার লাশটি যেন বাঙালীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ব্রিটিশ সাংবদিক ডেভিড ফ্রস্ট একটি সাক্ষাৎকারে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপনি যখন দেখলেন, ওরা কবর খনন করছে তখন আপনার মনে কার কথা জাগলো? আপনার দেশের কথা? না আপনার স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের কথা? উত্তরে বঙ্গবন্ধু নিঃসংকোচে বললেন. ‘আমার প্রথম চিন্তা ছিলো আমার দেশ. তারপর আমার পরিবার। আমি আমার জনগনকেই বেশী ভালোবাসি।’সারা জীবন বঙ্গবন্ধুর একটিই স্বপ্ন ছিলো , বাংলার দুঃখি, অবহেলিত আর দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। তাঁর একটিই সাধ ছিলো নির্যাতিত মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরে প্রথম স্বাধীন বাংলায় পা রেখেই আবেগ আপ্লুত ও অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “ আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই, আমার সোনার বাংলা , আমি বড় ভালোবাসি বোধহয় তার জন্যই আমাকে বাংলায় ডেকে নিয়ে এসেছে।” বঙ্গবন্ধুর চোখেও তখন ছিলো সাড়ে সাত কোটি বাংলার মানুষের আশা আর অশ্রুসিক্ত ভালোবাসা। এজন্যই শতবর্ষ পরে, আজও তিনি অম্লান হয়ে আছেন কোটি কোটি বাঙালীর অন্তরে। দেশের ও দেশের মানুষের জন্য এ রকম ত্যাগী নেতা বিশ্বের ইতিহাসে কোথাও আছে বলে মনে হয় না। পরিশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সুপ্রভাত কবিতাটির শেষের কয়েকটি লাইনের কথা মনে পড়ছে,“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই”।

বিঃ দ্রঃ উক্ত লেখার সম্পূর্ণ দায়ভার লেখকের

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ
Mehnaj Belal
Roll : 19/03 Reg: 03062 Session : 2018-19 Faculty of Food Science and Technology Chattogram Veterinary and Animal Sciences University
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে আজ অবধি যুগে যুগে এমন সব ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটেছে, যাদের হাত ধরে মানবতার মুক্তির সনদ রচিত হয়েছে। বাংলাদেশ নামক এই ছোট্ট ভূ-খন্ডটির জন্মের সাথে যার নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তিনি আর কেউ নন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

একজন সন্তানের জন্মের সাথে তার পিতার সম্পর্ক যেমন থাকে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক। শেখ মুজিবুর রহমান "সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালী” হিসেবে বিশ্বব্যাপী নন্দিত এক চরিত্র আমাদের বঙ্গবন্ধু। ডেভিড ফ্রস্টের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "They have given everything for me because I was ready to give everything for them. I want to make them free. I have no objection to die. I want to see them happy. I become emotional when I feel the love and affection my people gave me."

রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। তিনি ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুন। ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ মহকুমা পরিদর্শনে আসা বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উপস্থিতিতে কিশোর মুজিব স্কুলের ভাঙা ছাদ দিয়ে পানি পড়া বন্ধে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই জানান দিয়েছিলেন যে, বাংলার ভাগ্যাকাশে আবির্ভূত হতে চলেছে এক নতুন সত্তার, এক নতুন ধূমকেতুর। এরপর থেকে রাজনীতির মঞ্চে তার উত্থান এবং সাফল্য সবই ইতিহাস।

ভারতভাগের পর যুবনেতা শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্রলীগের পরিণতির সাথে সাথে নিজের মেধা ও মানুষের জন্য কাজ করার প্রেরণা থেকেই উদ্বুদ্ধ বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে নিয়ে গেছেন স্বাধীনতার চূড়ান্ত রূপে। পাকিস্তান পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে তিনি যখন ভাষণ দিতেন, তখন কখনোই পূর্ব-পাকিস্তান বলতেন না, বলতেন পূর্ব বাংলা। বাংলার বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের দাবিতেই তিনি তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন জেলের প্রকোষ্ঠে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্র শেখ মুজিব অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দিয়ে তিনি বাংলার মুক্তি সংগ্রামকে আরও বেগবান করেছিলেন।

পাকিস্তানের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে করতে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার নয়নের মণি, সাধনার ধন । মার্কিন কূটনৈতিক অ্যার্চার ব্লাড তার গ্রন্থে লিখেছেন, শেখ মুজিব ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের “মুকুটহীন সম্রাট।” তবে এই মুকুটহীন সম্রাট হয়ে ওঠার পেছনের ইতিহাসটা সবাই গভীরভাবে লক্ষ্য করে থাকবে।

বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এক নিঃস্বার্থ স্বপ্ন ছিলো শোষণ, বঞ্চনামুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। তাই তো তিনি বলেছিলেন," এ প্রধানমন্ত্রীত্ব আমার কাছে কাঁটা বলে মনে হয়। আমি যদি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারি, আমি যদি দেখি বাংলার মানুষ দুঃখী, আর যদি দেখি বাংলার মানুষ পেট ভরে খায় নাই, তাহলে আমি শান্তিতে মরতে পারবো না।"

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী কিছু সেনাসদস্যের বর্বরোচিত হামলার কারণে তাঁর স্বপ্নগুলো তিনি নিজ হাতে বাস্তবায়ন করার সুযোগ পাননি। কিন্তু আজকের বাংলাদেশ থেমে নাই। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথকে অনুসরণ করে গণমানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যে স্বাধীনতা আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আর অনুপ্রেরণায় অর্জন করতে পেরেছি, সেই স্বাধীনতা ধরে রাখতে হলে আমাদেরকে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে দেশের জন্য মিলেমিশে কাজ করে যেতে হবে। তবুও যেন এক হাহাকার গুঞ্জে উঠে বারবার, “যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই। যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই। তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা “।

বিঃ দ্রঃ উক্ত লেখার সম্পূর্ণ দায়ভার লেখকের

একটি তর্জনী, স্বাধীনতা ও জাতির পিতা
কাজী মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন
টেকনিক্যাল অফিসার, পি,আর,টি,সি
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে একটি তর্জনীর ইশারায় গর্জে উঠেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সাড়ে সাত কোটি মানুষ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তর্জনী উঠিয়ে সেই ভাষণ এখন ইউনেস্কোর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ। ১৯৭১ সালের অনিশ্চিয়তা ভরা দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল পূর্ব বাংলার মানুষকে। দিয়েছিল বিপদসংকুল পথে এগিয়ে যাওয়ার পথরেখা। ২০১৭ সালের অক্টোবরে ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে এই ভাষণ এখন বিশ্বের সবার।

বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশ্যে বজ্রকন্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সেই বলিষ্ট তর্জনীর ইশারায়। সেইদিন সমগ্র বাঙালি জাতি জেগে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য। একটি তর্জনী প্রতিবাদের ভাষা ,অত্যাচারী জালিমদের হুশিয়ারী করে দেওয়া। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক। একটি তর্জনী, একটি নির্দেশ, একটি যুদ্ধ, একটি জাতির মুক্তি। এই তর্জনী নতুন প্রজন্মের কাছে একটি নতুন স্বপ্ন। এই তর্জনী এখনো আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে শক্তি জোগায়। আর এই তর্জনী নিয়ে এবার ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৃহত্তর বঙ্গবন্ধুর তর্জনী ভাস্কর্য মুক্তির ডাক (Call for Redemption) নির্মাণ হচ্ছে নরসিংদীতে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তেজদীপ্ত তর্জনী নিয়ে নির্মিত ভাস্কর্যটি উন্মোচনের অপেক্ষায় দিন গুনছে। ৪১ ফুট উচু ভাস্কর্যটি বিশ্বের হাত ভাস্কর্যের মধ্যে উচ্চতার দিক থেকে অন্যতম। এই ভাস্কর্যটি নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভাস্কর নির্মাতা অলি মাহমুদের বিশ্বাস, এই তর্জনী নিচে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করলে স্বীয় জাতি, ঐতিহ্য আর গৌরবময় সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি নিজের মধ্যে ভেসে উঠবে।

ভাস্কর্যটি নতুন প্রজন্মের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। ৭৫-এর পরে বিভিন্ন চক্র এদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। চেয়েছিল এই ভূখন্ড থেকে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস চিরতরে মুছে দিবে। কিন্তু আজকে প্রমাণিত বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলা যায় না। পৃথিবীর এমন কোন রাস্ট্র নাই যার নিজস্ব ইতিহাস নেই, সবদেশে একজন জাতির পিতা আছে, রয়েছে স্বাধীনতা, নিজস্ব ভাষা, ঠিক তেমনি বাংলাদেশে আছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস, একটি তর্জনী, একটি ভাষণ। যাহা সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে সাক্ষ্য হয়ে থাকবে।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একইসূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়, একটি সংগ্রামের প্রতীক। তাঁর একটি তর্জনীর ইশারায় পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার সুখ লাভ করিয়েছে। তিনি পৃথিবীতে এঁকেছেন নতুন সীমারেখার মানচিত্র, আকাশে উড়িয়েছিলেন লাল সবুজের নতুন পতাকা।

বঙ্গবন্ধু মানে শক্তি, উৎসাহ আর প্রেরণা। বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ। তাঁর অসাধারণ বাগ্নীতা, মানবিকতা, মানুষের প্রতি সহমর্মতির গুণে তিনি চির অমলিন। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের শিহরিত করে ও অনুপ্রাণিত করে।

বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। যিনি তাঁর বিচক্ষণতা, সাহস, ত্যাগ, মেধা আর অনন্য সাধারণ নেতৃত্বে, রাজনৈতিক নেতৃত্বে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচার, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবহেলিত বাঙালি জাতিকে দুর্বার অধিকার আদায়ে সচেতন করে তুলেছিলেন। তাঁর আপোষহীন নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করে ছিল। এই আন্দোলনকে বেগবান করেছিল, অপ্রতিরোধ্য করেছিল যা শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম দিয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাস্ট্রের।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য সত্তা। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ তাঁর অমর কীর্তি। এই দেশ হবে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে সক্ষম এক সোনার বাংলাদেশ, এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা জাতির পিতার সোনার বাংলাদেশ গড়তে বদ্ধপরিকর।

বিঃ দ্রঃ উক্ত লেখার সম্পূর্ণ দায়ভার লেখকের

বাবার মুখে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের গল্প
আবু মোহাম্মদ আরিফ
সেকশন অফিসার (চ.দা.), ওয়ান হেলথ ইনস্টিটিউট
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা পিতা বিভিন্ন সময় পারিবারিক আড্ডায় সন্তানদের নিকট মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্প বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তুলে ধরত। তারই একটি অংশ তুলে ধরলাম। ১৯৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বড় ছেলের স্কুল বন্ধ, সকালে নাস্তার টেবিলে বড় ছেলে বাবাকে বলল বাবা আজকে আমাদের স্কুল বন্ধ। আজ মহান বিজয় দিবস। বড় ছেলে বাবাকে বলল বাবা, বিজয় দিবস কি তুমি তা জানো? একথা শোনার সাথে সাথে বাবার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু আর নীরবতা। তখন বড় ছেলে বললো, বাবা তোমার চোখে পানি কেন? তুমি কথা বলছো না কেন? বাবার নির্বাক চোখের নিরবতা তাকে আরো অস্থির করে তোলে। ছেলের আর তর সহ্য হয় না। বাবা অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙ্গে মুখ খুললেন। ছেলেকে বললেন, বাবা আমি জানি, বিজয় দিবস কি। ছেলে বললো বাবা কি? বাবা বললেন শোন তাহলে ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ, আমি তখন স্থানীয় নাঙ্গলমোড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র। আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই গুমানমর্দ্দন ইউনিয়নের তদানীন্তন চেয়ারম্যান এডভোকেট এ. এম য়্যাহয়্যা অস্থির ভাবে পায়চারী শুরু করলেন। আমি বললাম দাদা তোমাকে একটু অস্থির লাগছে মনে হয়। তিনি বললেন ঢাকা থেকে খবর এসেছে ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছেন যে, এইবার স্বাধিকার বা সমঝোতা নয়, স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছেন এবং বলেছেন ২ ও ৩ মার্চ হরতাল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা, আমাকে ঢাকা যেতে হবে। বড় ভাই আরো বললেন, আমাদেরকে স্বাধীন হতে হবে। বড় ভাই চলে গেলেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু লক্ষ জনতার সম্মুখে ঘোষণা করলেন “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম”। এরপর দীর্ঘ প্রায় ১৭ দিন আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ হয়। হঠাৎ শুনি ২৬ মার্চ সকালে ঢাকায় ব্যাপক গোলযোগ হচ্ছে। পাকিস্তানি বাহিনী বাঙ্গালিদেরকে নির্বিচারে হত্যা করছে। তারপর রেডিও নিয়ে বসে পড়লাম। দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান আওয়ামীলীগ নেতা এম. এ. হান্নান সাহেবের কন্ঠে শুনতে পাই- মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের পাশে আছেন এবং যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, আমাদের যার যা আছে তা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে, শত্রুর মোকাবেলা করতে। এভাবে ৫ মিনিট তিনি বক্তব্য দেন।

একদিন শুনলাম আমাদের বাড়ি তথা চেয়ারম্যান বাড়ি আক্রমণ হবে। আমরা স্বপরিবারে নদী পার হয়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিলাম। এ ধরনের পরিস্থিতি আমাকে বিদ্রোহী করে তুলল। বঙ্গবন্ধুর আহবান এবং এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলাম। বদন চৌধুরীর বাড়ির তাহের, নিজ বাড়ির রফিকুল, কাশেম (পাতলা), মোঃ কাশেম, ছিপাতলীর আজিজুল হক, মির্জাপুর গ্রামের সেনাসদস্য জাহাঙ্গীর ও মনছুর প্রমুখ আমরা সংগঠিত হই এবং ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কাটাখালির মাষ্টার কুদ্দুস, নাঙ্গলমোড়ার ছমদ ও আনোয়ার ভাই আমাদের সংগঠিত করে পায়ে হেঁটে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আমরা প্রথম খিরামের পূর্বে নাঙ্গলমোড়ার বরকত উল্ল্যার খামারে পৌঁছায় এবং সেখান থেকে দুজন চাকমার সহায়তায় ৫০/৬০ মাইল পায়ে হেঁটে দুর্গম পথ অতিক্রম করি। মর্মকান্তি চৌধুরী নামক এক চাকমার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করে আবার যাত্রা শুরু করি। তারপর নতুন দুজন চাকমার সহায়তায় নিরাপদে দীর্ঘ পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে বর্ডার সংলগ্ন নদী পার হই, পার হওয়ার পর ভারতে এসে পড়ি। সেখানে একটি রেজিস্ট্রেশন অফিসে...

আরো পড়ুন

সুবর্ণজয়ন্তীর সাতকাহন - ১
ড. জুনায়েদ ছিদ্দিকী
প্রফেসর, প্যাথলজি ও প্যারাসাইটোলজি বিভাগ
বৃটিশরাজ এর শোষণ শেষে- বাঙ্গালীরা আশায়,
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হলেও- জীবনটা কাটবে ভালবাসায়।
শোষণ আবার শুরু হলো- নতুন মুখোশ পড়ে,
পূর্ব-পশ্চিম দুই পাকিস্তান- যেমন ছিল দুরে।
ধীরে ধীরে নিষ্পেষিত- বাঙ্গালীরা ভাবে,
কারজয়ী কোন নেতার ডাকে- সংগঠিত তারা হবে?
শিক্ষা, দীক্ষা, উন্নয়নে- সব কিছুতেই তারা,
পিছিয়ে পড়ে দিনে দিনে- আতœসম্মান হয় হারা।
জাতির এমন ক্লান্তিলগ্নে- আসে ঐ বায়ান্ন,
দেয় যে তারা আত্নাহুতি- মায়ের ভায়ার জন্য।
বাধ্য হয়ে শাসকগোষ্ঠী- দেয় সে অধিকার,
স্বপ্ন দেখে সেই প্রজন্ম- বীজে বুনে স্বাধীনতার।
শোষণ, জুলুম চলছে তবু- বাঙ্গালীরা নিরুত্তর,
অবশেষে যে রক্ত ঝড়ে- আসাদ এর শার্ট ঐ,
সুপ্ত চেতনা বাঙ্গালীরা জাগে -স্বাধীনতা আজ কই’?
নেতা ছিলেন প্রতীক্ষাতে- হয় জনতার বোধোদয়,
একাত্তরে তাইতো হলো- স্বাধীনতার সূর্যোদয়!
শোষণমুক্ত সমাজ গড়বো- প্রত্যয় অগ্নিঝড়া,
মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি যদিও- এই প্রজন্মের মোরা।
করছি লালন সেই সে স্বপ্ন- আলোকিত আগামীর,
বৈষম্য ঘুচবে সর্বস্তরে- আসবে যে দিন হাসির।
পৃথিবীতে আজ বাঙ্গালীরা আছে- ঈর্ষনীয় সফলতায়,
ভবিষ্যতের প্রজন্ম দেশকে নিবে- আরো নতুন উচ্চতায়।
বাঙ্গালীরা বীরের জাতি- প্রমান হয়েছে বারংবার,
‘মুক্তিযুদ্ধ আর -স্বাধীনতা- তাইতো আমাদের অহংকার।

বিঃ দ্রঃ উক্ত লেখার সম্পূর্ণ দায়ভার লেখকের

সুবর্ণজয়ন্তীর সাতকাহন - ২
ড. জুনায়েদ ছিদ্দিকী
প্রফেসর, প্যাথলজি ও প্যারাসাইটোলজি বিভাগ
লাখো শহীদের ত্যাগের ফসল- এসেছিল মুক্তির গানে,
’স্বাধীনতা’ তাই নয় শুধু শব্দ- আছে যেন ঐ অভিধানে!
পরাধীনতার শেকল ভাঙ্গে- মুক্তিপাগল মোদের,
একাত্তরের চেতনা তাই- স্বপ্ন যে নতুন রোদ্দুরের!
অগ্নিঝরা একাত্তুরের - সাত-ই মার্চ এর ভাষণ,
স্বপ্নপাগল বাঙ্গালীর মনে- স্বাধীনতার অন্বেষণ!
নেতার ডাকে প্রস্তুতি নেয়- করে মরণপণ,
কেউ কি জানতো ? হায়েনারা ও নিচ্ছিলো প্রশিক্ষন?
শান্তিপ্রিয় বাঙ্গালী তাই- অস্ত্র ধরলো সেদিন,
‘স্বাধীনতা চাই’ শ্লোগান ছিলো- শপথ বজ্র কঠিন!
অভিনেতা ভুট্টো এলেন- চললো অভিনয়,
নেতা বলেন- স্বাধীনতা চাই’..... আর কোন কথা নয়’!
দৃপ্তকন্ঠ নেতার চিত্তে- জনতার স্বপ্ন-গাঁথা,
ভাবছে সবাই- স্বাধীনতা কবে’?- আনবে খুশীর বারতা?
অবশেষে আসলো সে রাত- পঁচিশ তারিখ শেষে,
ঝাঁপিয়ে পড়ে শেয়াল, শকুন- প্রতিহিংসার আশে।
চায় যে তারা মাটি শুধুই- করে সব ধ্বংস,
‘সাহস কত? স্বাধীনতা চাস? তোরা হবি নির্বংশ!
হায়েনাদের এই অট্টহাসি- চারিদিকে কান্নার রোল,
বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা- ফুটায় তাদের হুল।
পুরনো অকেজো থ্রী নট থ্রী- ভাঙ্গা যে রাইফেলের বাট,
এসব নিয়েই রণাঙ্গণে যায়- পিছু ফেলে বাড়ী, মাঠ, ঘাট।
সাহসে সংগ্রামে এগিয়ে ছিল- সঙ্গে ছিল দেশপ্রেম,
তারা-ই তো আসল মুক্তিযোদ্ধা- চায়নি তো নেম, ফেম!
আজকের এই নতুন সূর্য- তাদেরই-তো উপহার,
নতুন প্রজন্ম ভুলোনা যেনো- ‘স্বাধীনতা মোদের অহংকার’!

বিঃ দ্রঃ উক্ত লেখার সম্পূর্ণ দায়ভার লেখকের

চেতনায় বঙ্গবন্ধু, অস্তিত্বে বাংলাদেশ
অন্তর সরকার
৪র্থ বর্ষ, মাৎস্যবিজ্ঞান
ভূমিকা
সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মহান মন্ত্রের উচ্চারণে বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, যে অধ্যায়ের নাম বাংলাদেশ। এই অধ্যায় লেখা হয়েছে ৯ মাসব্যাপী অকুতোভয় বীরের রক্ত কালিতে, আমাদের ভাই হারানো ব্যাথা আর মা বোনের অমূল্য সম্ভ্রমের মূল্যে। যে অধ্যায়ের রচয়িতা একজন অদ্বিতীয় জনমানুষের কবি, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ বিজয়ের স্বাদ পেয়েছি আমরা যাঁর ২৩ বছরের সংগ্রামে। ৪৭ এর দেশভাগ থেকে ৫২ এর শহীদের রক্তখচিত বর্ণমালা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান থেকে ৭১ এর প্রলয়ংকারী মুক্তির সংগ্রাম, ডিসেম্বরের বিজয়, একজন বঙ্গবন্ধু ও একটি বাংলাদেশ। দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষায় বাঙালি জাতির দীর্ঘ ২৫ বছরের শোষণ-নিপীড়ন থেকে চিরদিনের জন্য মুক্তি, একটি স্বাধীন দেশ, লাল-সবুজ পতাকা, একটি সংবিধান ও একটি অনন্য অস্তিত্ব। আজও বাংলাদেশের প্রতিটা ধূলিকণায় ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত লেগে আছে, জলধারায় এখনো বয়ে চলেছে একাত্তরের কান্না। আজ আমরা স্বাধীন, স্বনির্ভর, আমাদের আছে গৌরবের ইতিহাস, আমাদের আছে বাঙালি সত্ত্বা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য। আমাদের চেতনায় বেঁচে আছে বঙ্গবন্ধু আর আমাদের অস্তিত্ব জুড়ে আছে বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ
‘মুজিব মানেই বাংলাদেশ, আমার লাল-সবুজ পতাকা
মুজিব মানেই মুক্তি, মুজিব মানেই স্বাধীনতা‘

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, একটি অপরটির পরিপূরক, পরস্পর একাত্ম, এক সুতোয় বাঁধা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই সাধক যিনি তাঁর দীর্ঘ কন্টকাকীর্ণ সাধনায় সমগ্র বাঙালি জাতির মনে সঞ্চার করেছিলেন স্বাধীনতার বাসনা। একটি বদ্বীপের জাতীয়তাবাদের চেতনা তুলে ধরা, একটি ঘুমন্ত জাতিকে তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার করা, তাদের সকল শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে শেখানো স্বাধীনতার একজন অনন্য স্থপতি তিনি। বাঙালি জানে, সারা বিশ্ব জানে, বাংলাদেশ সৃষ্টির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আলাদা কোন স্বত্তা নন, বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু, এই কথা অনস্বীকার্য।তাঁর যাত্রা শুরু ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে নয়। ক্রান্তিলগ্নে এই ভূখণ্ডের কোটি জনগণের চূড়ান্ত সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হয়েই বঙ্গবন্ধু উপাধি তিনি অর্জন করেছেন । এই পরিচয় কর্মে, ত্যাগে, সংগ্রামে, সাধনায়, নেতৃত্বে তাঁর জন্মসূত্রে পাওয়া নামকেও ছাপিয়ে যায়। ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের প্রচারে কিংবা ক্ষমতাকেন্দ্রের দাপট কিন্তু তাঁর মহিমা বাড়ায় না। বরং তাঁর কর্ম ও আদর্শ অনুসরণেই তাঁর অনন্য বিকাশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে...

আরো পড়ুন

মহান মুক্তিযুদ্ধ
সামান্তা কায়সার
ব্যাচঃ ১০ম অনুষদঃ খাদ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়
সূচনাঃ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত বাংলার মানুষের একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম। বাঙালির আবহমান কালের ইতিহাসের এক মাইলফলক ১৯৭১। এক মহিমান্বিত ইতিহাস রচিত হয়েছে ১৯৭১ সালে। স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের আজন্ম লালিত স্বপ্ন। পাকিস্তানিদের অধীনে দাস হয়ে থাকতে চায়নি বাঙালিরা। রক্ত, অশ্রু আর অপরিসীম আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে একাত্তরে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা । আর বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অভ্যুদয় হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের । মুক্তিযুদ্ধ তাই আমাদের জাতীয় জীবনে এক অহংকার ,গৌরবের এক বীরত্বগাঁথা।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুইটি পৃথক রাষ্ট্র। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ছিল দুটি অংশ পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক-বেসামরিক ও রাজনৈতিকসহ সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যে জর্জরিত করতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানকে। শিল্প কারখানার কাঁচামালের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান নির্ভর করতো পূর্ব পাকিস্তানের ওপর। পূজিবাদী ভাবধারায় শ্রমিকদের অল্প বেতন দিয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অপরদিকে উৎপাদনের কাজ করাহত। অপরদিকে রাজস্ব থেকে আয়, রপ্তানি আয় প্রভৃতির সিংহভাগ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় যেখানে ৯৫% ব্যয় হতো, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় ব্যয় হতো মাত্র ৫ শতাংশ।
পরবর্তীতে ১৯৭০ এর নির্বাচনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী কোনোভাবে বাঙালির হাতে শাসনভার তুলে দিতে চায়নি । পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অভাব, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ, অবকাঠামোগত উন্নয়নে অবহেলা, মৌলিক নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপসহ সকল প্রকার বৈষম্য স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠনের দাবিকে জোরালো করে তোলে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশ
বাঙালি জাতির রাজনৈতিক সচেতনতা ও জাতীয়তাবাদের সূচনা হয় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই। তৎকালীন পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশেরই বাস ছিল পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু, শাসন ক্ষমতার চাবিকাঠি কুক্ষিগত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। ক্রমেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর-শাসন শোষণের স্বরুপ পূর্ববাংলার জনগণের সামনে স্পষ্ট হতে থাকে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই শতকরা ৫৬ জনের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানি শাসকরা শতকরা ৭ ভাগ লোকের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে । পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণা পূর্ব বাংলার মানুষের মাঝে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ১৫৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ববাংলার প্রতিবাদী জনতা দেশের মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষা নেন । ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর এই আঘাতের পরই বাঙালি বুঝতে পারে তাদের স্বাতন্ত্র্যকে । তারা বাঙালি জাতি এই পরিচয় তাদের মধ্যে দৃঢ় হতে শুরু করে ।
দেশ মাতৃকার কল্যাণে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এসময় গঠিত হয় বেশ কিছু সংগঠন । ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬২ এর শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ১৯৬৬ এর ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচনে বিপুল ভোটে ১৬৭ টি আসনে আওয়ামী লীগের বিজয়, এই প্রত্যেকটি ঘটনার মাধ্যমে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটে এবং ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সেই জাতীয়তাবাদ চূড়ান্ত স্বীকৃতি লাভ করে ।

স্বাধীনতার ডাক
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। বরং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকার তখন ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর ফলে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতায় উন্মুখ দশ লক্ষাধিক মানুষের সামনে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন। “আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শুনিয়েছিলেন তাঁর অমর-কবিতাখানি:
"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
এরপর থেকেই গড়ে ওঠে তীব্র অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে সৃষ্টি হয়েছিল অনন্য এক ইতিহাস। তাঁর সেই ১১ মিনিটের বক্তব্যেই স্বাধীনতার বীজ লুকায়িত ছিল।

২৫ এ মার্চের কালরাত্রি এবং স্বাধীনতার ঘোষণা
নির্বাচনে এমন বিপুল জয়ের পরেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা শুরু করে। এরই মধ্যে ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে গোপনে পূর্ব পাকিস্তানে আসতে থাকে অস্ত্র আর সামরিক বাহিনী। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নয়, মাটি চাই বলে হানাদার বাহিনীকে নির্দেশ প্রদান করে ঢাকা ত্যাগ করে পৃথিবীর অন্যতম জঘন্য গণহত্যার হোতা ইয়াহিয়া খান।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারেই শুরু হয় ইতিহাসের ঘৃণিত হত্যাযজ্ঞ, যা অপারেশন সার্চ লাইট নামে পরিচিত। এ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। তারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।
মধ্যরাতের পর হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রেফতারের পূর্বেই অর্থাৎ ২৬ এ মার্চের প্রথম প্রহরে গোপন তারবার্তায় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার স্বাক্ষরিত ঘোষণাবার্তাটি তৎকালীন ইপিআর এর ট্রান্সমিটারের সাহায্যে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয় । এরপর চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ এ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে প্রচারিত হয় স্বাধীনতার ঘোষণা। ২৬শে মার্চ দুপুরে এম এ হান্নানও চট্টগ্রামের কালুরঘাটের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম।

মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধ
১২ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে সিলেটের তেলিয়াপাড়ার চা বাগানে কর্নেল এম এ.জি ওসমানীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য পুরো দেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয় । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর সর্বাধিনায়ক। জুন মাসের শেষের দিকে গেরিলারা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আগস্টে গঠিত নৌ কমান্ডে বীরত্ব ও কৃতিত্বের সাথে যুদ্ধ শুরু করে। ৩ ডিসেম্বর থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাঙালিদের সাথে ভারতীয় সেনারাও যোগ দেয়। মিলিতভাবে গঠিত হয় মিত্রবাহিনি।

মুজিবনগর সরকার গঠন
১০ এপ্রিল ১৯৭১ কুষ্টিয়ার বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা ইউনিয়নের ভবের পাড়া গ্রামের আম্রকাননে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। এই জায়গার নতুন নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। তাই এই সরকারকে বলা হয় মুজিবনগর সরকার।
সে সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে, রাষ্ট্রপতি শাসিত এই সরকার ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। এই দিনই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। পরবর্তীতে এই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হতে থাকে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ও সুদূরপ্রসারী সাংবিধানিক পদক্ষেপ ছিল মুজিবনগর সরকার গঠন। এই সরকারের নেতৃত্বে নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। বিশ্বব্যাপী জনসমর্থন আদাযে এই সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও জনযুদ্ধ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ চালানোর পর বাঙালি ছাত্র, জনতা, পুলিশ, ইপিআরসহ সর্বস্তরের মানুষ সাহসিকতার সাথে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে । দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে বহু মুক্তিযোদ্ধা রণাঙ্গনে শহিদ হন, আবার অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। মাতৃভূমির প্রতি তাই মুক্তিযোদ্ধাদের এ ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না। এদেশের মানুষ চিরকাল জাতির এই সূর্য সন্তানদের মনে রাখবে। মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক শক্তি দিল জনগণ। তাই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ নিজ নিজ অবস্থান থেকে যুদ্ধে ভূমিকা নেয়।

মুক্তিসংগ্রাম ও কৃষক
আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মানুষ, এদেশের কৃষক শ্রমিকগণ যে ভূমিকা রেখেছিলেন স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল, তারা অস্ত্রহাতে যেমন ছিলেন যুদ্ধের মাঠে, তেমনি দেশের অভ্যন্তরেও প্রতিরাধে ও সশস্ত্র অবরোধে অংশ নিয়েছিলেন ব্যাপকভাবে। মুক্তিসংগ্রাম ধারণার মধ্যে দুটি উপাদান আছে। একটি হলো জাতীয় মুক্তি এবং অন্যটি অর্থনৈতিক, সামাজিক, শ্রেণিগত শোষণমুক্তি। আর এই মুক্তির মন্ত্রক দিল আমাদের কৃষকসমাজ। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যারা যুদ্ধে ঝাঁপিযে পড়েন, তাদের বেশিরভাগই ছিলেন গ্রামের সাধারণ কৃষিজীবী মানুষ। তাদের বীরত্বগাথা ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়। সুদীর্ঘ বন্ধনার পথ পেরিয়ে এসে তারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেছেন। তাই যে হাতে তারা লাঙল ঠেলেছেন, ধান কেটেছেন, নৌকার দাঁড় টেনেছেন, জীবিকার জন্য প্রাণান্ত শ্রম দিয়েছেন সে হাত তাদের উদ্যত হযেছি শত্রুর মোকাবিলায়।

মুক্তিযুদ্ধ ও ছাত্র সমাজ
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল অহঙ্কার করার মতো। একক গোষ্ঠী হিসেবে ছাত্রদের সংখ্যা ছিল বেশি। গোটা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। দেশের সব আন্দোলনে গৌররোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে এদেশের দ্বাত্র সমাজ। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের অবদানের কথা বলতে গেলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা, সোপর্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্য। বাংলাদেশে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ ও ৬৪ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালে ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভ্যানগার্ড হিসেবে তৎকালীন ছাত্রসমাজের ভূমিকা অপরিসীম। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বড় অংশ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়।

মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক দল
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী প্রধান রাজনৈতিক দল হলো আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগই সর্বপ্রথম পূর্ববাংলার জনগণকে স্বাধিকার আন্দোলনে সংগঠিত করে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাকে সাড়া দিয়েই এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে । বস্তুত, তিনি দিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফফর), কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় কংগ্রেস ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকবাহিনীর সমর্থনে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, পিডিপিসহ কতিপয় বিপথগামী রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে।

মুক্তিযুদ্ধ ও গণমাধ্যম
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করতে এবং জনমত গঠনে দেশ - বিদেশ থেকে অসংখ্য পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল, মুজিবনগর সরকার ও প্রবাসী বাঙালিদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংসলীলা, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ, শরণার্থী শিবিরের বর্ণনা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে । যুদ্ধের সময়ে দেশপ্রেম জাগ্রতকরণ, মনোবল বৃদ্ধিসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে শিল্পী-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ও অবদান ছিল খুবই প্রশংসনীয়। পত্রপত্রিকায় লেখা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে খবর পাঠ, দেশাত্নবোধক ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান, আবৃত্তি,নাটক, কথিকা, জনপ্রিয় অনুষ্ঠান 'চরমপত্র ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।

মুক্তিযুদ্ধে নারী
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা ছিল অনন্য অনবদ্য। নারী সক্রিয় ছিল কখনও সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে, কখনো বা যুদ্ধক্ষেত্রের আড়ালে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন এমন নারীর সংখ্যা অসংখ্য। অজানা-অচেনা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রুষা করেছেন বহু নারী। চরম দুঃসময়ে পাকিস্তানি হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিযেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। অনেক সময়ে শত্রুর কাছে নিজেদের সম্ভ্রম এবং প্রাণও দিতে হযেছে।

মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের অবদান
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিরা সর্বতোভাবে পাশে ছিলেন। বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। বিভিন্ন দেশে তারা মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ে বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের কাছে দুটে গিয়েছেন। তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছেন। পাকিস্তানকে অস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহ না করতে বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের নিকট আবেদন করেছেন। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মুক্তিযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের কাহিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে দাঁড়ায় । ভারত সে সময় এক কোটিরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়ে বিশ্বজনমত তৈরিতে এগিয়ে এসেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দেয়। তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের বিরোধিতা করলেও সে দেশের জনগণ বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশকে সমর্থন দেয় । তাদের প্রতিরোধের মুখে মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিটলস এর জর্জ হ্যারিসন এবং ভারতীয় পন্ডিত রবি শংকর 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এর আয়োজন করেছিলেন। ফরাসি সাহিত্যিক আন্দ্রে মারোযা, জ্যা পল সাত্রে সহ তানেকেই বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে যৌথ বাহিনী
১৯৭১ সালে যুদ্ধের প্রায় শেষদিকে ২১ নভেম্বর ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডার লে. জে জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশ - ভারত যৌথ কমান্ড। ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী মিত্রবাহিনী নাম নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুক্ত হওয়া ভারতীয় বিমান হামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

মুক্তিযুদ্ধ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড
মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি ও যৌথবাহিনীর দুর্বার প্রতিরোধ ও আক্রমণের মুখে পশ্চিমা হানাদার বাহিনী যখন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তখন পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে এ দেশের সূর্য সন্তানদের ওপর। আর এ কাজে তাদেরকে সাহায্য করে তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদর আল শামস বাহিনী। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী দেশের মুক্তিকামী ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের বেশিরভাগের ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়।

আত্মসমর্পণ এবং বাঙালির বিজয়
সংগ্রামী বাঙালি আর মিত্র বাহিনীর সাথে যুদ্ধে হানাদার বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অর্থাৎ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ৯৩০০০ সৈন্য নিয়ে জেনারেল নিয়াজি সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং আরোরার নিকট আত্মসমর্পণ করেন। এসময় বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার। এর মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।
“রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা, সে আমার স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন-
স্বাধীনতা, সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।"

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ক্ষুধাদারিদ্র-অশিক্ষা-কুসংস্কার থেকে মুক্ত অসাম্প্রদায়িক একটি দেশের - বঙ্গবন্ধু যার নাম দিয়েছিলেন 'সোনার বাংলা’। এই সোনার বাংলা গঠনের চেতনাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। নতুন প্রজন্মের কাছে এই চেতনাকে গৌছে দেওয়া জরুরি। কেননা উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এই চেতনার কোনো বিকল্প নেই।

উপসংহার
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির অহংকার। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ জাতিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এনে দেয়। এই স্বাধীনতা ত্রিশ লক্ষ ভাইযের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত, লক্ষ মা-বোনের সমভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া। তাই এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমাদের নিবেদিতপ্রাণ হওয়া উচিত। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো যেমন জরুরি, তেমনি নাগরিকদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন হওয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কর্তব্যবোধে, ন্যায়নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে বাংলাদেশের যথার্থ অগ্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব।

বিঃ দ্রঃ উক্ত লেখার সম্পূর্ণ দায়ভার লেখকের

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ
মো: মঞ্জুরুল হাসান
তৃতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সেমিস্টার, ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ
“শোনো একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রনি
বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ”

কোনো জাতি যখন প্রকৃতই কোনো সংকটের সম্মুখীন হয়, তখন ঠিকই সেই জাতির পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে আবির্ভাব ঘটে কোনো না কোনো মহাপুরুষের। আবির্ভাব ঘটেছিল রাশিয়ায় ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, আমেরিকায় আব্রাহাম লিংকন, ভিয়েতনামে হো চি মিন, চীনে মাও সে তুঙ, তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক, যুগোশ্লোভিয়ায় মার্শাল টিটো, ভারতবর্ষে মহাত্মা গান্ধী, দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা, কিউবায় ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ফিলিস্তিনে ইয়াসির আরাফাত, আর বাংলাদেশে আবির্ভাব ঘটেছিল এমনই এক উজ্জ্বল জ্যোতিস্কের, ইতিহাসের পাতায় যার নাম চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে, তিনি আর কেউ নন তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ার বুকে যে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র আজ মানচিত্রে জ্বলজ্বল করে, সেই রাষ্ট্রটির গঠনে সবথেকে বড় অবদান শেখ মুজিবের। সে জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশ তাকে দিয়েছে জাতির জনকের সম্মান। শেখ মুজিব ছাড়া আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনাই করা যেত না।

১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ, ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ৩রা চৈত্র, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভূক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের বাইগার নদী তীরবর্তী টু্ঙ্গিপাড়া গ্রামে মা সায়েরা খাতুনের কোল আলো করে জন্ম নেন শেখ মুজিব। চার বোন আর দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। শেখ মুজিবকে সাত বছর বয়সে ভর্তি করা হয় গিমাডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, বছর দুই গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে, তারপর পিতার বদলিসূত্রে ভর্তি হন মাদারিপুর ইসলামিয়া স্কুলে। ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৪ সালে আই.এ. পাশ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন বি. এ. ডিগ্রি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন আইন বিভাগে....

আরো পড়ুন

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী
Mehanaj Afrin
ID: 17/28, Reg.No: 01784 Faculty of Fisheries Chattogram Veterinay and Animal Sciences University
ভূমিকা
২৬ মার্চ ১৯৭১ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি দেশের নামের অন্তর্ভুক্তি ঘটে। এ দিনের নবীন সূর্যোদয়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ স্বাধীনতা দিবসের আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তের মধ্যে প্রথমেই যে কথা মনে পড়ে, তা হলো এ দেশের অসংখ্য দেশপ্রেমিক শহীদের আত্মদান। আজ বাঙালি স্বাধীন। ব্রিটিশরা নেই, পাকিস্তানিরা নেই, জমিদাররা নেই। প্রতিবছর গৌরবময় এ দিনটি পালন করতে গিয়ে আমাদের কর্তব্য হয়ে উঠে স্বাধীনতার স্বপ্ন ও সাধ আমরা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি, জাতীয় জীবনে আমাদের অর্জন কতটুকু আর বিশ্বসভায় আমাদের অবস্থান কোথায় সেসব মিলিয়ে দেখা। এদিক থেকে স্বাধীনতার ৫০ বছর দিনটি আমাদের আত্মসমালোচনার দিন, হিসাব মেলাবার দিন ও আত্মজিজ্ঞাসার দিন।

বিজয়ের ৫০ বছর পরের বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মতো নতুন দেশের যাত্রা ছিল নানাভাবে কণ্টকাকুল ও বিপৎসংকুল। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ। ভৌত-অবকাঠামো, রাস্তাঘাট- ব্রিজ যানবাহন, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, প্রায় সবকিছুই বিনষ্ট বিধ্বস্ত। প্রশাসন অসংগঠিত ও অনুপস্থিত। বৈদেশিক মুদ্রার শূন্য ভান্ডার ও ভারসাম্যহীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। নিঃস্ব, সহায়-সম্বলহীন কোটি শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন চ্যালেঞ্জ। বিশ্বমন্দা ও নানা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বন্যা, খাদ্যাভাব, সামাজিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি।

স্বাধীনতাযুদ্ধে একসঙ্গে যাঁরা যুদ্ধ করলেন তাঁদের মধ্যে ঘোরতর বিভক্তি। চরমতম রাজনৈতিক অস্থিরতা, রক্তারক্তি গুম ও খুন। কলকারখানায় লুটপাট ও আগুন। মুনাফাখোর, মজুতদার ও চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম এবং ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অবিশ্বাস্য অগ্নিমূল্য। অবশেষে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। হতভম্ব জাতি। স্বাধীনতার প্রথম ২-৩টি বছর একটি দুর্বিষহ দুঃসময় যার সঠিক ও বাস্তব মূল্যায়ন কখনো নির্মোহভাবে হয়নি।

আজ বাংলাদেশ ও স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে ৫০ বছর পূর্তির দ্বারপ্রান্তে। তাই পেছন ফিরে তাকালে আমাদের স্বস্তির অনেক কারণ পাওয়া যায়। অন্তত এ ৫০ বছরে আমাদের অর্জন খুব একটা কম নয়, এক কথায় অসামান্য। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের সময় পৃথিবীর অন্যতম দারিদ্রপীড়িত দেশ ছিলো। মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষই ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আজ তা নেমে এসেছে ২০ শতাংশের নীচে যা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে নির্দেশ করে। কিন্তু দেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করলেও থেকে গেছে প্রকট ধন বৈষম্য। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দেশের অগ্রগতি জানতে হলে বিশ্লেষণ প্রয়োজন ১৯৭১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সামষ্টিক ও ব্যাষ্টিক অর্থনীতি সম্পর্কে দেশের অবস্থান। ১৯৭০ সালে স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল শুধু ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ২০২০ সালে এসে অনুমিত জিডিপি ৮৬০.৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৭০-এ মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১৪০ ডলার, ২০১৮-২০১৯ এ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৯০৯ ডলার এবং ২০২০-এ তা ২০৬৪-এ উন্নীত হয়। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি, ২০১৯-২০২০ এ ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি এবং ২০২০-২০২১ সালের বাজেট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে উন্নয়ন বাজেটের আকার ছিল ৫০১ কোটি টাকা যা ২০২০-২১ সালে হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। এসব কিছুর প্রতিফলন দেখা যায় বিদ্যুতায়ন, গ্রামীণ সড়কের ঘনত্ব, শিল্পায়ন, গৃহায়ণ, নগরায়ণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, দারিদ্র্য বিমোচন প্রভৃতি ক্ষেত্রে। সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আমাদের ৫০ বছরের অগ্রগতি স্বস্তিদায়ক। যেমন সার্বিক সাধারণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, গড় আয়ু, ইপিআই নারীর ক্ষমতায়ন, জন্ম ও মৃত্যুহার হ্রাস ইত্যাদিতে অগ্রগতির উল্লেখ করা যেতে পারে।

অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে গার্মেন্টস শিল্প। সত্তরের দশকের শেষের দিকে রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে এই শিল্পের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্পখাত। ২০১৯ সালেও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। জেনেভায় এক সম্মেলনে একথা জানিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। ১৯৮১-৮২ সালে মোট রপ্তানি আয়ে এই শিল্প খাতের অবদান ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসে গার্মেন্টস শিল্প থেকে। সময়ের পরিক্রমায় গার্মেন্টস শিল্প সম্প্রসারণ হতে থাকে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে গার্মেন্টস শিল্প বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বর্তমানে গার্মেন্টস শিল্পে প্রায় ৪০.৪৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলছে। ২০১৯ সালে ১৮ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে ছিলেন প্রবাসীরা যা আগের বছরে ছিলো ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালের রেমিট্যান্স আসে প্রায় ১৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার যা বিগত বছর গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আমাদের দেশের প্রবৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয় প্রবাসীদের পাঠানো এই রেমিট্যান্সকে যা প্রত্যাশার শীর্ষে।

আরো পড়ুন